জন্ডিস: IMCI শ্রেণীবিভাগ ও মূল্যায়ন
নবজাতকের জন্ডিস একটি সাধারণ অবস্থা, যা তাদের ত্বকে ও চোখের সাদা অংশে হলুদাভ ভাব সৃষ্টি করে। এটি রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে ঘটে। বিলিরুবিন হল লোহিত রক্তকণিকা ভাঙার ফলে তৈরি হওয়া একটি হলুদ রঙের রঞ্জক পদার্থ। যদিও অনেক ক্ষেত্রে জন্ডিস হালকা এবং নিজে থেকেই সেরে যায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি গুরুতর হতে পারে এবং চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। Integrated Management of Childhood Illness (IMCI) শিশুদের অসুস্থতার ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) প্রণীত নির্দেশিকা। এই নির্দেশিকা অনুসারে, শিশুদের জন্ডিসের তীব্রতা নির্ণয় এবং শ্রেণীবিভাগ করার জন্য নির্দিষ্ট মানদণ্ড রয়েছে।
নবজাতকের জন্ডিস: কারণ, লক্ষণ ও শ্রেণীবিভাগ
নবজাতকের জন্ডিসের কারণগুলির মধ্যে রয়েছে অপরিপক্ক লিভার, মায়ের রক্তের গ্রুপের সাথে শিশুর রক্তের গ্রুপের অমিল, সংক্রমণ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা। জন্ডিসের প্রধান লক্ষণ হল ত্বক এবং চোখের সাদা অংশে হলুদাভ ভাব। অন্যান্য লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে ঘুম ঘুম ভাব, বুকের দুধ বা ফর্মুলা কম খাওয়া এবং দুর্বল চোষা। IMCI নির্দেশিকা অনুসারে, জন্ডিসকে মূলত তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়: মৃদু জন্ডিস, মাঝারি জন্ডিস এবং তীব্র জন্ডিস। হাতের তালু ও পায়ের তলায় হলুদাভ ভাব দেখা গেলে, এটি সাধারণত মাঝারি থেকে তীব্র জন্ডিসের লক্ষণ। এই ক্ষেত্রে, IMCI শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী, এটিকে তীব্র জন্ডিস হিসেবে গণ্য করা উচিত। কারণ, হাতের তালু ও পায়ের তলায় হলুদাভ ভাব বিলিরুবিনের উচ্চ মাত্রার নির্দেশক, যা মস্তিষ্কের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
IMCI শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী জন্ডিসের প্রকারভেদ
IMCI (Integrated Management of Childhood Illness) নির্দেশিকা অনুসারে, জন্ডিসকে তীব্রতা অনুযায়ী তিনটি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। এই শ্রেণীবিভাগ শিশুদের জন্ডিসের সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে এই শ্রেণীবিভাগগুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
-
মৃদু জন্ডিস (Mild Jaundice): মৃদু জন্ডিসের ক্ষেত্রে, হলুদাভ ভাব সাধারণত মুখ এবং বুকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। হাতের তালু ও পায়ের তলায় এই হলুদাভ ভাব দেখা যায় না। এই ধরনের জন্ডিস প্রায়শই শারীরিক জন্ডিস (Physiological Jaundice) হিসেবে পরিচিত, যা জন্মের কয়েক দিনের মধ্যে আপনা আপনি সেরে যায়। তবে, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি, যাতে কোনো জটিলতা না হয়। মৃদু জন্ডিসের ক্ষেত্রে, শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণে বুকের দুধ খাওয়ানো বা ফর্মুলা দুধ দেওয়া এবং নিয়মিত রোদে রাখা (সরাসরি সূর্যের আলো নয়) সাধারণত যথেষ্ট।
-
মাঝারি জন্ডিস (Moderate Jaundice): মাঝারি জন্ডিসের ক্ষেত্রে, হলুদাভ ভাব বুক থেকে পেট পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। এই ক্ষেত্রে, হাতের তালু এবং পায়ের তলায় হলুদাভ ভাব দেখা যেতেও পারে, আবার নাও দেখা যেতে পারে। মাঝারি জন্ডিসের জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে, যেমন ফটোথেরাপি। ফটোথেরাপি একটি বিশেষ ধরনের আলো যা বিলিরুবিনকে ভাঙতে সাহায্য করে, যাতে এটি শরীর থেকে সহজে নির্গত হতে পারে। এই পর্যায়ে, নিয়মিত বিলিরুবিনের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি।
-
তীব্র জন্ডিস (Severe Jaundice): তীব্র জন্ডিস একটি মারাত্মক অবস্থা, যেখানে হলুদাভ ভাব পেট ছাড়িয়ে হাত ও পায়ের তালু পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এই ক্ষেত্রে, বিলিরুবিনের মাত্রা অনেক বেশি থাকে এবং এটি মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে, যা কার্নিকটেরাস (Kernicterus) নামক একটি জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। কার্নিকটেরাস একটি স্থায়ী স্নায়বিক ক্ষতি, যা শিশুর বিকাশে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। তীব্র জন্ডিসের জন্য জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা প্রয়োজন, যার মধ্যে ফটোথেরাপি এবং ক্ষেত্রবিশেষে রক্ত সঞ্চালন (Blood Transfusion) অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
যদি কোনো নবজাতকের হাতের তালু ও পায়ের তলায় হলুদাভ ভাব দেখা যায়, তবে IMCI নির্দেশিকা অনুযায়ী এটিকে তীব্র জন্ডিস হিসেবে গণ্য করা হয়। এই অবস্থায় দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা শুরু করা অত্যন্ত জরুরি।
জন্ডিসের তীব্রতা নির্ণয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন
জন্ডিসের তীব্রতা নির্ধারণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন হল রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা পরিমাপ করা। এটি একটি সাধারণ রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে করা হয়। বিলিরুবিনের মাত্রা যত বেশি, জন্ডিস তত তীব্র। এছাড়াও, শিশুর সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য লক্ষণগুলিও মূল্যায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে শিশুর খাওয়ানোর ক্ষমতা, কার্যকলাপের স্তর এবং তাপমাত্রা। কিছু ক্ষেত্রে, অন্তর্নিহিত কারণ সনাক্ত করার জন্য অতিরিক্ত পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। জন্ডিসের তীব্রতা নির্ণয়ের জন্য আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন নিচে উল্লেখ করা হলো:
-
শারীরিক পরীক্ষা (Physical Examination): শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে জন্ডিসের তীব্রতা প্রাথমিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়। এক্ষেত্রে, ত্বক এবং চোখের সাদা অংশের হলুদাভ ভাব পরীক্ষা করা হয়। হলুদাভ ভাব শরীরের কতটা অংশ জুড়ে ছড়িয়েছে, তা দেখে জন্ডিসের তীব্রতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়াও, শিশুর অন্যান্য লক্ষণ, যেমন ঘুম ঘুম ভাব বা দুর্বলতা, পর্যবেক্ষণ করা হয়।
-
বিলিরুবিনের মাত্রা পরিমাপ (Measurement of Bilirubin Level): রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা পরিমাপ করা জন্ডিসের তীব্রতা নির্ণয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই পরীক্ষা সাধারণত দুটি উপায়ে করা হয়:
- মোট সিরাম বিলিরুবিন (Total Serum Bilirubin - TSB): এটি রক্তে মোট বিলিরুবিনের পরিমাণ নির্ণয় করে।
- ট্রান্সকুটেনিয়াস বিলিরুবিনোমিট্রি (Transcutaneous Bilirubinometry - TcB): এই পদ্ধতিতে ত্বক ভেদ করে বিলিরুবিনের মাত্রা মাপা হয়, যা একটি ব্যথাহীন প্রক্রিয়া।
-
নবজাতকের বয়স এবং ঝুঁকির কারণ (Age and Risk Factors of the Newborn): জন্ডিসের মূল্যায়ন করার সময় নবজাতকের বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সময়ের আগে জন্ম নেওয়া (Premature) শিশুদের মধ্যে জন্ডিসের ঝুঁকি বেশি থাকে। এছাড়াও, মায়ের রক্তের গ্রুপের সাথে শিশুর রক্তের গ্রুপের অমিল (যেমন Rh অসামঞ্জস্য) এবং অন্যান্য জেনেটিক কারণেও জন্ডিস হতে পারে।
-
অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা (Other Health Issues): জন্ডিসের পাশাপাশি শিশুর অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে, তা জন্ডিসের তীব্রতা এবং চিকিৎসাকে প্রভাবিত করতে পারে। সংক্রমণ, লিভারের সমস্যা, বা অন্য কোনো বিপাকীয় ত্রুটি জন্ডিসের কারণ হতে পারে।
সঠিক রোগ নির্ণয় এবং সময়োপযোগী চিকিৎসার জন্য এই মূল্যায়নগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জন্ডিসের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ
জন্ডিসের চিকিৎসা বিলিরুবিনের মাত্রার উপর নির্ভর করে। হালকা জন্ডিসের ক্ষেত্রে, শুধুমাত্র ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়ানো বা ফর্মুলা খাওয়ানো এবং পর্যাপ্ত আলোতে রাখাই যথেষ্ট হতে পারে। মাঝারি থেকে তীব্র জন্ডিসের ক্ষেত্রে, ফটোথেরাপি (Phototherapy) নামক একটি বিশেষ চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে। ফটোথেরাপিতে, শিশুকে একটি বিশেষ আলোতে রাখা হয় যা বিলিরুবিনকে ভাঙতে সাহায্য করে। মারাত্মক ক্ষেত্রে, রক্ত সঞ্চালনের (Blood Transfusion) প্রয়োজন হতে পারে।
জন্ডিস প্রতিরোধের জন্য, গর্ভাবস্থায় মায়ের Rh অসামঞ্জস্যের মতো ঝুঁকির কারণগুলো সনাক্ত এবং চিকিৎসা করা উচিত। জন্মের পর, শিশুকে দ্রুত এবং ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত, যা বিলিরুবিনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। জন্মের পর প্রথম কয়েক দিনের মধ্যে সব নবজাতকের জন্ডিসের জন্য নিয়মিত স্ক্রিনিং করা উচিত।
উপসংহার
নবজাতকের জন্ডিস একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, এর তীব্রতা এবং সম্ভাব্য জটিলতা সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি। IMCI নির্দেশিকা অনুসারে, হাতের তালু ও পায়ের তলায় হলুদাভ ভাব দেখা গেলে, এটিকে তীব্র জন্ডিসের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা উচিত। সময়োপযোগী রোগ নির্ণয় এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে, জন্ডিসের কারণে সৃষ্ট জটিলতাগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব। আপনার শিশুর মধ্যে জন্ডিসের লক্ষণ দেখা গেলে, দ্রুত একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করুন।